প্যারিসের রাস্তায় একদল প্রবাসী বাংলাদেশি হাতে গ্লাভস আর ময়লা রাখার প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে ফুটপাথের নানা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। তা দেখে পথচারী ফরাসিদের চোখে একরাশ বিস্ময়। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই ভূমিকায় তারা একাধারে বিস্মিত ও মুগ্ধ। কারণ, এ কাজের জন্য বিখ্যাত এই শহরের পৌর কর্তৃপক্ষের রয়েছে বিশাল কর্মীবাহিনী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য রয়েছে আধুনিক সরঞ্জাম। তাদের রয়েছে নির্দিষ্ট পোষাকা। দেখলে সহজেই তাদের চেনা যায়।
কাজটি চিরচেনা, কিন্তু কার্য সম্পাদকেরা একেবারেই অপরিচিত। হ্যাঁ, তারা বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্সের (বিসিএফ) সদস্য। বিসিএফ অনলাইনভিত্তিক একটি সামাজিক সংগঠন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শহরজুড়ে বিশেষভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের অংশ হিসেবে বিসিএফ-এর অংশগ্রহণের কার্যক্রমের অংশ এটি। প্যারিস ১৩-এর Rue du Chevaleret এর ১ থেকে ১৫৩ পর্যন্ত পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ করে এই দলটি।
এ কর্মসূচিতে অংশ নেন ২৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশি। তারা হলেন এমডি নুর, এ কে এম ওয়াসিউজ্জামান, কাব্য কামরুল, আকাশ মোহাম্মদ হেলাল, সারোয়ার জাহান, ফরিদ আহমেদ, আবদুর রহমান, মিজানুর রহমান, সালেহউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, মাহফুজ আহমেদ, শাহেদ আহমেদ, মাসুম আহমেদ, মোহাম্মদ মোশাররফ, মামুন খান, রেজাউল করিম, নুরুল ইসলাম, আবদুল মোমিন, আহসানুল করিম, শিকদার মান্না রহমান, হুমায়ূন কবির, শাহেদুল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমুল হাসান, এমডি রায়হান আহমেদ ও তৌহিদ বিন আজাদ প্রমুখ।
ফরাসি ‘Paris fais-toi belle’-এর ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘Paris is beautiful’. এটি একটি বিশ্বজনীন সত্য। কিন্তু এ রকম একটি স্লোগান নিয়ে প্যারিস নগরীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শহরের সৌন্দর্যকে রক্ষার আকুলতা নিয়ে ২০১৪ সালে শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে শুরু হয়েছিল La journee du Grand Nettoyage কর্মসূচি। যার লক্ষ্য ছিল নাগরিকের নিজস্ব রাস্তাটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে তারা নিজেরাই যেন উদ্যোগী হন।
প্যারিস কারও কাছে স্বপ্নের শহর, কারও কাছে অর্ধেক মানবী-অর্ধেক কল্পনা, কেউ ডাকে সৌন্দর্য রানি বলে। শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রেম আর দ্রোহের এক অদ্ভুত শংকরায়ন, এক স্পর্ধিত অহংকারের সংমিশ্রণ এই প্যারিস শহর। যুগে যুগে সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষের কাছে প্যারিস শহর এক আকর্ষণীয় প্রার্থিত বস্তু।
কিন্তু Push factor আর pull factor-এর অভিঘাতে উন্নত দেশগুলোর প্রধানতম শহরগুলোতে অভিবাসীর আবাস আর বসবাসের জন্য মানুষের শহরমুখী জীবনকে বেছে নেবার কারণে শহরের নানামুখী সমস্যার মধ্যে অন্যতম এক সমস্যা দেখা দেয় রাস্তাঘাটের যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা। প্যারিস শহরের সৌন্দর্য সেই আগ্রাসী বদ-অভ্যাসের দাপটে ম্লান হয়ে পড়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের প্রশিক্ষিত জনবল আর নানা আধুনিক যন্ত্রপাতিও প্যারিসের মুখটিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। আজ থেকে দুই যুগ আগেও শহরের রূপটি এমন ছিল না।
ইদানীং যত্রতত্র প্রস্রাবের দুর্গন্ধ, থুতু, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, পলিথিন ও নিত্য ব্যবহারিক প্লাস্টিকসামগ্রীর উন্মুক্ত ভাগাড়ে পরিণত হয়ে আছে এই প্যারিস শহরের অলিগলি। এই অবাঞ্ছিত অভ্যাসগুলোয় খোদ ফরাসিদের কোনো অংশগ্রহণ নেই, থাকবার কথাও নয়। অভিবাসীদের এক বিশাল অংশ এই শহরে বসবাস করছেন। নতুন যারা আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসছেন তাদেরও লক্ষ্যও এই প্যারিস শহর। ভিন্ন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং দৈনন্দিন যাপিত জীবনে পারিপার্শ্বিক গণ্ডিকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ববোধের চর্চাটা নেই বললেই চলে।
কিন্তু মায়াবী শহরটি তো আমাদের শহর। খোদ ফরাসিদের এবং অভিবাসীদের। নানা বর্ণ, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মিশেলে গড়া এক চমৎকার জেনারেশনের বসবাস এখানে। সেখানে কিছু অনিয়ম, অসৌন্দর্য, অবাঞ্ছিত কর্মকাণ্ড সক্রিয়তা থাকতেই পারে। কিন্তু সমাজে যারা দায়বোধকে নিজের একটা ধর্মবোধের মতোই গণ্য করে তাদের দায়িত্ববোধটাও আপনা থেকেই জেগে ওঠে। বিসিএফ সেই দায়বোধ থেকেই এই অভিযানে অংশ নিয়েছে। এমনটাই জানালেন সংগঠনের প্রধান এমডি নুর। তিনি জানালেন, এই প্রিয় শহরে আমরা বাস করি। রাষ্ট্র আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্রকে আমরা কি দিচ্ছি? আর আমাদের আবাসের চারিদিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদেরই দায়িত্ব। এটা কোনো বাহবা পাওয়ার আশায় করা কাজ নয়, এর তাগিদটি আমাদের চেতনার ভেতর থেকেই এসেছে।
ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশিদের অনলাইনভিত্তিক সংগঠনটির এমন কর্মসূচি চলাকালীন দেখা গেছে খোদ ফরাসিরা এ কাজকে বাহবা দিচ্ছেন, করতালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন। কোনো কোনো ফরাসি আবার এদের জিজ্ঞেস করেছেন কোন্ দেশের অধিবাসী। বাংলাদেশের কথা শুনে তারা তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
ক্ষুদ্র এক দেশ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক বিবেচনায় অতিক্ষুদ্র, কিন্তু মনটি তাদের বিশাল। চিন্তাভাবনায় স্বকীয়তা আছে, উদ্ভাবনী আছে, বৈচিত্র্য আছে, দায়বদ্ধতা আছে, সামষ্টিক কল্যাণময়তার আকুলতা আছে। এ কারণেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার এ অভিযানে শামিল হওয়া। শুরু হলো সীমিত আকারে, বছর ঘোরার চক্রবাকে এর পরিসর বাড়তে থাকবে। আর বাংলাদেশ কমিউনিটির এই প্রয়াস বাংলাদেশকে ভিনদেশিদের কাছে পরিচিত হবে অন্য এক মাহাত্ম্য মাধুর্যে, এমনটাই আশাবাদ।
সূত্র, প্রথম আলো